ভি ডি সাভারকরই প্রথম ১৮৫৭ খ্রিঃ বিদ্রোহকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস চর্চার আওতার মধ্যে নিয়ে আসেন। ১৯০৯ খ্রিঃ এক প্রবন্ধে এবং "ইন্ডিয়ান ওয়ার ইন্ডিপেনডেন্স" গ্রন্থে তিনি ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহকে ভারতের "প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ" বলে অভিহিত করেন।
কি কারনে মহাবিদ্রোহকে তুমি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলবে? |
তাঁর মতে "স্বধর্ম" ও "স্বরাজের" জন্য হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ ভাবে ১৮৫৭ খ্রিঃ যে সংগ্রাম শুরু করেছিলো, তা নিঃসন্দেহে ছিলো একটি জাতীয় সংগ্রাম এবং ভারতের" প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ"। পরবর্তীকালে সাভারকরের এই মতকে সমর্থন করেন বহু ঐতিহাসিক। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন -
- অশোক মেহতা,
- রনজিৎ গুহ,
- গৌতম ভদ্র,
- সুপ্রকাশ রায়,
- সুশোভন সরকার প্রমুখ।
অনেক গুলি কারনেই সাভারকরের এই মত যুক্তিযুক্ত বলে মনে করা হয়। যেমন -
- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বলতে যদি ইংরেজ বিতাড়নকে বোঝায়, তাহলে ১৮৫৭ খ্রিঃ বিদ্রোহে বিদ্রোহীরা তো এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বিদ্রোহ শুরু করেছিলো।
- ১৮৫৭ র বিদ্রোহেই প্রথম ভারতের সব শ্রেনীর মানুষ ইংরেজ ইংরেজ বিরোধিতায় সামিল হয়েছিলেন।
- এই বিদ্রোহে যে কয়েক লক্ষ মানুষ আত্মত্যাগ করেছিলো, প্রান বিসর্জন করেছিলো, তার দৃষ্টান্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অন্য কোন আন্দোলনে দেখা যায় নি।
- জাতীয় কংগ্রেসের যে আন্দোলন গুলিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের তকমা দেওয়া হয়, সেইসব আন্দোলন গুলি শেষপর্যন্ত ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো। কিন্তু ১৮৫৭ র বীর বিদ্রোহী দেশপ্রেমিকরা আত্মসমর্পণের বদলে আত্মবিসর্জনের নীতি নিয়েছিলো।
- এই বিদ্রোহে যে বিপুল পরিমান মানুষের মৃত্যু হয়, তা পরবর্তীকালের অন্যকোন স্বাধীনতা আন্দোলনে লক্ষ্য করা যায় নি। ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত কোন আন্দোলনে এত মানুষের মৃত্যু কখনই সম্ভব নয়।
- কংগ্রেস পরিচালিত তথাকথিত স্বাধীনতা আন্দোলন গুলির ব্যপকতা ও গভীরতা থেকেও মহাবিদ্রোহ কোন অংশে কম ছিলো না।
- ভারতের কোন স্বাধীনতা আন্দোলনেই সব অংশের মানুষ সামিল হয় নি। মহাবিদ্রোহেও সব অংশের মানুষ সামিল হয় নি। কিন্তু তাই বলে একে স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা যাবে না, সমালোচকদের এই বক্তব্যও ঠিক নয়। ভারতের বাকি অংশের অসহযোগীতাকে গুরুত্ব দিয়ে উত্তর ও মধ্য ভারতের সংগ্রামের গুরুত্বকে উপেক্ষা করার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
মনে রাখতে হবে, ১৮৫৭ র ভারত ছিলো"একটি ভৌগলিক সংজ্ঞা"। সুতরাং আজকের আধুনিক জাতীয় চেতনা ও স্বাধীনতার তত্ব দিয়ে ১৮৫৭ র মূল্যায়ন করলে সেটা ইতিহাসের অবমূল্যায়ন ছাড়া আর কিছুই হবে না। আজকের কষ্ঠিপাথরে বিগত দিনের ইতিহাসকে মূল্যায়ন করা অর্থহীন। স্বাধীনতার এক অর্থ যদি হয়, বিদেশী অধিনতা থেকে নিজেদের মুক্ত করা, তাহলে ১৮৫৭ র বিদ্রোহীরা অবশ্যই এটি করেছিলেন। এবং শুধুমাত্র এই যুক্তিতেই ১৮৫৭ র বিদ্রোহকে নিঃসন্দেহে আমরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বলতে পারি।
ডঃ এস বি চৌধুরী বলেছেন, ১৮৫৭ বিদ্রোহেই প্রথম বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ একসঙ্গে সমবেতভাবে বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে ছিলেন। এই রূপরেখার ওপর ভর করেই আগামী ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ এগিয়ে চলেছিলো। মহাবিদ্রোহ ছিলো এই প্রচেষ্টারই প্রথম পদক্ষেপ। এদিক থেকে বিচার করে ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহকে অবশ্যই "ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ" বলা চলে।