১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বিতর্ক রয়েছে। বলা বাহুল্য, আজও এই বিতর্কের নিষ্পত্তি ঘটে নি। মহাবিদ্রোহের এমন ৪ টি জায়গা বা দিক রয়েছে, যা নিয়ে এই বিদ্রোহ শুরুর সময় থেকেই ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি ও ধোঁয়াশা লক্ষ্য করা যায়। এই ধারনাগত বিভ্রান্তি বা ধোঁয়াশা থেকেই মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে নানা মত ও বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছে।
বিভ্রান্তিকর এই ৪ টি দিক হলো -
- মহাবিদ্রোহের ব্যপকতা ও বিস্তার,
- এই বিদ্রোহের স্থানীয় বা আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা,
- রাজ্য ছাড়া কতিপয় সামন্ত রাজার বিদ্রোহে যোগদান,
- স্বাধীন ভারতের সম্রাট রূপে বিদ্রোহীদের দিল্লির বাদশাহের নাম ঘোষনা বা ব্যবহার।
উপরে উল্লেখিত মহাবিদ্রোহের এই ৪ টি দিক সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, তা থেকে ঐতিহাসিকরা মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতের অবতারনা করেন।
সহজ করে বলতে গেলে, ঐ ৪ টি দিককে ব্যবহার করে কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন, মহাবিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহীদেরই বিদ্রোহ ছিলো। কেউবা আবার এই ৪ টি দিককে অন্যভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন করে দেখাতে চেয়েছেন, মহাবিদ্রোহ একটি জাতীয় সংগ্রাম ছিলো অথবা একটি সামন্ত বিদ্রোহ ছিলো।
১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহ কি একটি জাতীয় সংগ্রাম ছিলো? |
মোটকথা, মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত গবেষনার ভিত্তিতে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ৩ টি প্রধান মত উঠে এসেছে। যথা -
- মহাবিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহীদের বিদ্রোহ ছিলো।
- মহাবিদ্রোহ ছিলো একটি সামন্ততান্ত্রিক অভ্যুত্থান।
- মহাবিদ্রোহ ছিলো একটি জাতীয় সংগ্রাম। এটি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিলো।
জাতীয় বিদ্রোহ নাকি সিপাহী বিদ্রোহ : বিতর্ক
১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের শুরুর সময় থেকেই এটি "জাতীয় বিদ্রোহ নাকি একটি সামরিক বিদ্রোহ" - তা নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। পরবর্তীকালে ১৯৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের শতবর্ষ উদযাপনের বৎসরে নতুন করে এই বিতর্ক দানা বাঁধে। আজও এই বিতর্কের নিরসন হয় নি।
আসলে বর্তমান সময়কালের ঐতিহাসিকদের মতো মহাবিদ্রোহ চলাকালীন সময়ের সমসাময়িক তথ্যকার ও বিবরনীকারদের মধ্যেও এই বিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। তাই মহাবিদ্রোহের সমসাময়িক সময়ে কেউ এই বিদ্রোহকে নিছকই একটি "সিপাহী" বিদ্রোহ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউবা আবার একে শুধু সিপাহী বিদ্রোহ হিসাবে না দেখে একে একটি জাতীয় সংগ্রাম হিসাবে দেখেছেন।
পরস্পর বিরোধী শিবির
স্পষ্টতই মহাবিদ্রোহের প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ একে জাতীয় সংগ্রাম বলা যায় কিনা, সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে পরস্পর বিরোধী শিবির তৈরি হয়েছে।
একদিকে রয়েছেন, সমকালীন সময়ের চার্লস রেকস, জন সিলি, স্যার জন লরেন্স, অক্ষয় কুমার দত্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, সৈয়দ আহমেদ খান, দাদাভাই নৌরজী, জন কে, কিশোরীচাঁদ মিত্র এবং প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত। যারা এই বিদ্রোহকে শুধু সিপাহী বিদ্রোহ বলেই দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
অন্যদিকে রয়েছেন, সমকালীন সময়ের উইলিয়াম কে, জে বি নটন, ম্যালেসন, চার্লস বল, আলেকজান্ডার ডাফ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কার্লস মার্কস এবং ঐতিহাসিকদের মধ্যে আছেন - অশোক মেহতা, রনজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র, সুপ্রকাশ রায়, সুশোভন সরকার। এরা নানা তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, ১৮৫৭ র বিদ্রোহ নিছক সিপাহী বিদ্রোহ ছিলো না। এটি ছিলো জনগনের সংগ্রাম এবং যথার্থ অর্থেই একটি "জাতীয় সংগ্রাম" ।
বিনায়ক দামোদর সাভারকরই প্রথম মহাবিদ্রোহকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার আওতার মধ্যে নিয়ে আসেন। তিনি ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি নির্নয় করতে গিয়ে একে "ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ" বলে আখ্যায়িত করেন।
জনসমর্থনের তত্ত্ব
এখন ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ যেভাবে ব্যপকতার সঙ্গে বিস্তার লাভ করেছিলো এবং প্রায় সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিলো, তা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, শুধুমাত্র সিপাহীদের দ্বারা এই বিদ্রোহ সংগঠিত হলে বা তাদের দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকলে কখনই তা এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারতো না।
মহাবিদ্রোহের "ব্যপকতা ও বিস্তার" থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, এই বিদ্রোহের ভিতরে এবং বাইরে স্পষ্ট জনসমর্থন ছিলো। সমকালীন তথ্যকার থেকে আধুনিক ঐতিহাসিক, সকলেই এই বিষয়টি স্বীকার করে থাকেন। এটা মহাবিদ্রোহকে যারা সিপাহী বিদ্রোহ বলেন, তারা যেমন স্বীকার করেন। তেমনই যারা এই বিদ্রোহকে একটি জাতীয় সংগ্রাম হিসাবে আখ্যায়িত করেন, তারাও স্বীকার করেন।
অর্থাৎ মহাবিদ্রোহের অন্যান্য অনেক বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তথ্যগত বা ধারনাগত বিভ্রান্তি থাকলেও, একটিমাত্র বিষয়ে প্রত্যেকের অবস্থান স্পষ্ট ছিলো, মহাবিদ্রোহের পিছনে জনগণের একটি বড়ো অংশের অংশগ্রহণ বা সমর্থন ছিলো। যে কারনটির জন্যই এই বিদ্রোহ এতখানি "ব্যপকতা" লাভ করতে পেরেছিলো।
এখন প্রশ্ন হলো, জনসমর্থন আছে বলেই কি আমরা সিপাহী বিদ্রোহকে একটি "জাতীয় সংগ্রাম" বলবো? সবথেকে বড়ো প্রশ্ন। এখনই আমরা এর উত্তর দিতে পারি না।
এখানে এটিও মাথায় রাখতে হবে, এই বিদ্রোহে জনসাধারণ কেন অংশগ্রহণ করেছিলো, তার ব্যাখ্যা দুই ঘরানার ঐতিহাসিকরা, অর্থাৎ যারা মহাবিদ্রোহকে সিপাহী বিদ্রোহ বলতে চান আর যারা এটিকে একটি জাতীয় সংগ্রাম বলতে চান, উভয়ে নিজের নিজের মতো করে দিয়েছেন।
মোটকথা, দুই শিবিরের যুক্তিগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষন করবার পরই আমরা সিদ্ধান্তে আসবো ১৮৫৭ র বিদ্রোহকে যথার্থ অর্থেই একটি জাতীয় সংগ্রাম বলা যায় কিনা।
জাতীয় সংগ্রামের বিরুদ্ধ মত ও যুক্তি
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি নিয়ে যারা গবেষনা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, টমাস মেটকাফ, রজনীপাম দত্ত। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ কোন মতেই একটি জাতীয় বিদ্রোহ ছিলো না। স্বাধীনতা সংগ্রাম তো ছিলোই না।
ডঃ মজুমদার তার মতের স্বপক্ষে বেশকিছু জোরালো যুক্তি ও তথ্যপ্রমান পেশ করেছেন -
(১.) প্রথমত - ডঃ মজুমদার স্বীকার করেছেন, মহাবিদ্রোহের সঙ্গে জনগণের একটা অংশের যোগ ছিলো। কিন্তু জনসংযোগ ছিলো বলেই তিনি এই বিদ্রোহকে "জাতীয় বিদ্রোহ" বলার পক্ষপাতী নন। তার মতে, সিপাহী বিদ্রোহে অসামরিক জনগনের বিদ্রোহ গুলি ছিলো সামরিক বিদ্রোহেরই প্রতিক্রিয়া মাত্র। অর্থাৎ তার মতে, যখনই কোন বিদ্রোহ ঘটে, তখনই বাইরের জনগনের একটি অংশ ঐ বিদ্রোহে নানা ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। মহাবিদ্রোহের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটাই ঘটেছিলো।
কোম্পানির শাসনকালে উচ্চহারে ভূমিরাজস্ব নীতির কারনে জনসাধারণের একটি বড়ো অংশের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিলো। পরে সিপাহীরা বিদ্রোহ করলে ঐ জনসাধারণের একটি অংশ তাদের ক্ষোভ প্রশমনের উপায় হিসাবে বিদ্রোহে সামিল হয়। এখানে মাথায় রাখতে হবে, জাতীয়তাবাদের কোন আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা কখনই বিদ্রোহে সামিল হয় নি।
(২.) দ্বিতীয়ত - রমেশচন্দ্র মজুমদার দেখিয়েছেন, ১৮৫৭ র বিদ্রোহ ভারতের বৃহত্তর এলাকাকে স্পর্শও করতে পারে নি। বাংলা ও পাঞ্জাবে এই বিদ্রোহের কোন প্রভাব পড়ে নি। দক্ষিণ ভারতও কার্যত শান্ত ছিলো। এটি জাতীয় সংগ্রাম হলে অবশ্যই তা বৃহত্তর ভারতকে স্পর্শ করতে পারতো। কিন্তু তা হয় নি।
(৩.) তৃতীয়ত - ডঃ মজুমদার তার মতের স্বপক্ষে তৃতীয় যুক্তিতে বলেছেন, চর্বি মাখানো টোটা ব্যবহারকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলমান সিপাহীরা চরম ধর্মদ্রোহীতা ঘোষনা করে জাতিচ্যুত হবার ধুঁয়া তুলে যেভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সামিল হয়, তাকে আর যাই হোক, বিদ্রোহ-ই বলা যায়। জাতীয় সংগ্রাম কখনই বলা যায় না।
তার মতে, যেকোন দেশের জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে "ঐক্যবদ্ধ চেতনা" এবং "ঐক্যবদ্ধ আদর্শ" গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। ধর্মীয় দিকটি সেখানে ব্রাত্যই থাকে। কিন্তু মহাবিদ্রোহে ধর্মকে ব্যবহার করে, ধর্মদ্রোহীতা ঘোষনা করে, জাতিচ্যুত হবার ধুঁয়া তুলে যেভাবে বিদ্রোহ শুরু হয়, তাকে আর যাই হোক, আধুনিক অর্থে কখনই একটি" জাতীয় সংগ্রাম" বলা চলে না।
(৪.) চতুর্থত - ডঃ মজুমদার তার মতের স্বপক্ষে আরও বলেছেন যে, ১৮৫৭ র বিদ্রোহে অধিকাংশ দেশীয় রাজা, জমিদার, এমনকি ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী অংশ নেয় নি। অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। এটি জাতীয় সংগ্রাম হলে, নিশ্চয়ই এরা এই বিদ্রোহকে সমর্থন করতেন।
(৫.) পঞ্চমত - ডঃ মজুমদার বলেছেন, যেকোন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব পন করে। বেশিরভাগ জনগন নিস্ক্রিয় থেকে তাদের নৈতিক সমর্থন জানায়। কিন্তু মহাবিদ্রোহকে যারা সমর্থন করে নি, তারা তাদের নৈতিক সমর্থন জানিয়েছিলো ইংরেজদের প্রতি। এদের অনেকে বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্যও করেছিলো। তাহলে ১৮৫৭ র বিদ্রোহকে কোন যুক্তিতে আমরা একটি জাতীয় সংগ্রাম বলবো? - পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন ডঃ মজুমদার।
(৬.) ষষ্ঠত - কিছু সামন্তরাজা ব্যক্তিস্বার্থে এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন। মহাবিদ্রোহে যারা নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন, যেমন নানাসাহেব, লক্ষীবাঈ, প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারনেই বিদ্রোহে সামিল হন। নানাসাহেবের ভাতা ইংরেজরা বন্ধ করে দিয়েছিলো। লক্ষীবাঈ রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বিদ্রোহে সামিল হন।
বিদ্রোহীদের মধ্যে কোন যোগাযোগও ছিলো না। যার ফলে বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ শুরু হয়। কোন ঐক্যবদ্ধ লক্ষ্য, আদর্শ, উদ্দেশ্য বিদ্রোহীদের ছিলো না। প্রত্যেকেই ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত হয়েছিলেন এবং ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্যই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন। ব্যক্তিস্বার্থে সংগঠিত এই বিদ্রোহকে তাই "বিদ্রোহ" ই বলা যেতে পারে, জাতীয় সংগ্রাম নয়।
(৭.) সপ্তমত - "ঐক্যবদ্ধ চেতনা" এবং "ঐক্যবদ্ধ আদর্শ" যেকোন দেশের জাতীয় আন্দোলনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহাবিদ্রোহে এর একান্তই অভাব ছিলো। মহাবিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে নানা স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লক্ষ্য করা যায়। উত্তর প্রদেশের রায়বেরিলি, হরিদ্বার, কঙ্খল, মোরাবাদে হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের অবনতি দেখা যায়। জাতীয় ঐক্য, জাতীয় চেতনা ও জাতীয় আদর্শবাদের দ্বারা এই বিদ্রোহ ঘটে থাকলে কখনই হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের অবনতি লক্ষ্য করা যেতো না।
(৮.) অষ্টমত - ডঃ মজুমদার তার মতের স্বপক্ষে আরোও একটি যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, বাহাদুর শাহকে যখন বিদ্রোহীরা ভারত সম্রাট হিসাবে ঘোষনা করে, তখন মুঘল সাম্রাজ্য ও মুসলমান শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার আশঙ্কায় শিখ, রাজপুত, মারাঠা ও বাঙালি হিন্দুরা এই বিদ্রোহের বিরোধীতা করে। তাদের এই মনোভাব ও আচরন কোনটাই জাতীয় সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ন ছিলো না।
ঐক্যবদ্ধ চেতনা ও আদর্শবোধ যেকোন আন্দোলনের "জাতীয় আন্দোলন" হবার প্রথম শর্ত। আর ১৮৫৭ র বিদ্রোহ সেই শর্ত কোনভাবেই পূরন করতে পারে নি। আর এখানেই সে ব্যর্থ হয়েছে, জাতীয় সংগ্রামের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে।
(৯.) নবমত - রমেশচন্দ্র মজুমদার তার শেষ যুক্তিতে বলেছেন, যেকোন জাতীয় সংগ্রামে আমরা সবসময় দেশপ্রেম, আদর্শবোধ, সুপরিকল্পনা, ঐক্যমত, সংগঠন এবং শৃঙ্খলাবোধ থাকতে দেখি। যেকোন জাতীয় আন্দোলনের এগুলি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মহাবিদ্রোহে এর কোনটিরই দেখা মেলে না।
- মহাবিদ্রোহের পিছনে কোন আদর্শবোধ ছিলো না। এক একজন নেতা এক একটি দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন কোম্পানির শাসনে। ব্যক্তিগত ক্ষতিপূরণের ইচ্ছাতেই তারা বিদ্রোহে যুক্ত হন এবং নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।
- বিদ্রোহীদের মধ্যে কোন সংগঠন, ঐক্যবোধ, সুপরিকল্পনা না থাকায় বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিদ্রোহ শুরু হয়। যার ফলে ইংরেজদের পক্ষে এই বিদ্রোহ দমন করা সহজ হয়েছিলো।
- সর্বোপরি, বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহী রা যেভাবে লুঠতরাজ চালায় তা জাতীয় সংগ্রামের শৃঙ্খলাবোধ আদর্শেরও পরিপন্থী ছিলো।
সবদিক বিচার বিবেচনা করে রমেশচন্দ্র মজুমদার তাই সিদ্ধান্তে এসেছেন - "১৮৫৭ র প্রথম জাতীয়" স্বাধীনতা যুদ্ধ" না ছিলো প্রথম, না ছিলো জাতীয়, না ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধ।
১৮৫৭ র সিপাহী বিদ্রোহের মূল কারন ছিলো অর্থনৈতিক শোষন ও বৈষম্যমূলক নীতি। জাতীয় সংগ্রামের কোন মনোভাব এখানে লক্ষ্য করা যায় নি।
আসলে ১৮৫৭ র বিদ্রোহ ছিলো একটি সিপাহী বিদ্রোহ।
- সিপাহীরা প্রথম এই বিদ্রোহ শুরু করেছিলো।
- প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সিপাহীরাই এই বিদ্রোহে সক্রিয় ছিলো।
- মিরাট সেনানিবাস থেকে পরিকল্পনা মাফিক এই বিদ্রোহ যেভাবে অন্যান্য সেনা নিবাস গুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিলো, তাকে "সামরিক বিদ্রোহ" ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
জাতীয় সংগ্রামের স্বপক্ষে মত ও যুক্তি
অন্যদিকে ডঃ সুশোভন সরকার, ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন, ভি ডি সাভারকর প্রমুখ ঐতিহাসিকরা ডঃ মজুমদারের মতের বিপরীতে মহাবিদ্রোহকে একটি "জাতীয় সংগ্রাম" হিসাবে আখ্যায়িত করতে চান।
ভি ডি সাভারকর প্রথম ১৮৫৭ র বিদ্রোহকে জাতীয়তাবাদের ইতিহাস চর্চার আওতার মধ্যে নিয়ে আসেন। ১৯০৯ খ্রিঃ এক প্রবন্ধে এবং "ইন্ডিয়ান ওয়ার ইন্ডিপেনডেন্স" গ্রন্থে তিনি ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহকে ভারতের "প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ" বলে অভিহিত করেন।
তাঁর মতে "স্বধর্ম" ও "স্বরাজের" জন্য হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ ভাবে ১৮৫৭ খ্রিঃ যে সংগ্রাম শুরু করেছিলো, তা নিঃসন্দেহে ছিলো একটি জাতীয় সংগ্রাম।
এখন মহাবিদ্রোহকে যারা জাতীয় সংগ্রাম হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তারা তাদের মতের স্বপক্ষে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে তারা বিরুদ্ধ মতের তোলা প্রশ্ন ও যুক্তিগুলিকে যেমন খন্ডন করেছেন। তেমনই স্বমতের স্বপক্ষে রেখেছেন ততোধিক জোরালো যুক্তি ও ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমান।
(১.) প্রথমত - ডঃ মজুমদার বলেছিলেন, মহাবিদ্রোহে কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো না। কিন্তু ডঃ সুশোভন সরকার দেখিয়েছেন, চাপাটির আদান প্রদান স্পষ্টতই প্রমান করে, মহাবিদ্রোহে একটি পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো।
তাছাড়া, পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াও যেকোন বিদ্রোহ জাতীয় সংগ্রাম হয়ে উঠতে পারে। ইতিহাসে এর অনেক প্রমান আছে। এর সবথেকে বড়ো প্রমান হলো নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে স্পেন বা রাশিয়ার বিদ্রোহ। পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই এগুলি ইতিহাসে জাতীয় সংগ্রামের স্বীকৃতি পেয়েছে। এগুলি জাতীয় সংগ্রাম হলে মহাবিদ্রোহ কেন হবে না ভারতের জাতীয় সংগ্রাম? পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন ডঃ সরকার।
(২.) দ্বিতীয়ত - মনে রাখতে হবে, ১৮৫৭ র ভারত ছিলো"একটি ভৌগলিক সংজ্ঞা"। সুতরাং আজকের আধুনিক জাতীয় চেতনা ও স্বাধীনতার তত্ব দিয়ে ১৮৫৭ র মূল্যায়ন করলে সেটা ইতিহাসের অবমূল্যায়ন ছাড়া আর কিছুই হবে না। আজকের কষ্ঠিপাথরে বিগত দিনের ইতিহাসকে মূল্যায়ন করা অর্থহীন। স্বাধীনতার এক অর্থ যদি হয়, বিদেশী অধিনতা থেকে নিজেদের মুক্ত করা, তাহলে ১৮৫৭ র বিদ্রোহীরা অবশ্যই এটি করেছিলেন। এবং শুধুমাত্র এই যুক্তিতেই ১৮৫৭ র বিদ্রোহকে নিঃসন্দেহে আমরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বলতে পারি।
ডঃ এস বি চৌধুরী বলেছেন, ১৮৫৭ বিদ্রোহেই প্রথম বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ একসঙ্গে সমবেতভাবে বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে ছিলেন। এই রূপরেখার ওপর ভর করেই আগামী ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ এগিয়ে চলেছিলো। মহাবিদ্রোহ ছিলো এই প্রচেষ্টারই প্রথম পদক্ষেপ। এদিক থেকে বিচার করে ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহকে অবশ্যই ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা চলে।
(৩.) তৃতীয়ত - দেশপ্রেম যদি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়, তবে ১৮৫৭ বিদ্রোহ অবশ্যই ছিলো স্বাধীনতার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যে কয়জন মানুষের মৃত্যু হয়, সেই দৃষ্টান্ত পরবর্তী আর কোন আন্দোলনে দেখা যায় নি। মহাবিদ্রোহ ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত একটি আন্দোলন হলে কখনই এই বিরাট সংখ্যক মানুষের আত্মত্যাগ কখনই সম্ভব হতো না। বাস্তবে এটি ঘটতও না।
(৪.) চতুর্থত - ভারতের সকল শ্রেণীর মানুষ, সমস্ত অঞ্চলের মানুষ এই বিদ্রোহে যোগ না দেওয়ায় ১৮৫৭ র বিদ্রোহকে "স্বাধীনতা যুদ্ধ" বা "জাতীয় সংগ্রাম" বলা যাবে না, একথাও ঠিক নয়। ইতিহাসে এর বহু প্রমান আছে -
- আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে বহু আমেরিকান যোগ দেয় নি। তারা জাতীয় সংগ্রামে ইংল্যান্ডকে সমর্থন করেছিলো।
- ইতালির স্বাধীনতা যুদ্ধে বহু ইতালিয় অষ্ট্রিয়ার সমর্থক ছিলো।
- স্পেন বা রাশিয়ায় নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে বহু স্পেনীয় বা রাশিয়ান মানুষ নেপোলিয়নকে সমর্থন করেছিলো।
তা সত্ত্বেও ঐ গুলি জাতীয় সংগ্রাম হলে - ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় কিছু মানুষ ইংরেজদের সমর্থন করেছিলো বলে একে জাতীয় সংগ্রাম বলা যাবে না, এই যুক্তিরও কোন সারবত্তা নেই।
(৫.) পঞ্চমত - ১৮৫৭ র পরবর্তীকালে ভারতে জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত আন্দোলন গুলির ক্ষেত্রেও দেখা যায়, সেই সময় ভারতে ইংরেজ ভক্তের সংখ্যা কম ছিলো না। তারা বিভিন্ন ভাবে, জাতীয় আন্দোলনকে দমন করতে ইংরেজদের নানা ভাবে সাহায্য করেছিলেন। আবার সেইসব জাতীয় আন্দোলনের সময় অধিকাংশ স্বাধীন দেশীয় রাজাদের নৈতিক সমর্থনও থাকতো ইংরেজদের প্রতি। তারা জাতীয় আন্দোলন গুলি থেকে তাদের রাজ্যের প্রজাদের সরিয়ে রাখবার জন্য নানা দমনমূলক পদক্ষেপও নিতেন। তা সত্ত্বেও জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত আন্দোলন গুলি জাতীয় সংগ্রামের তকমা পেলেও মহাবিদ্রোহ কোন যুক্তিতে "জাতীয় সংগ্রাম" হবে না?
(৬.) ষষ্ঠত - বাহাদুর শাহকে স্বাধীন ভারতের সম্রাট হিসাবে ঘোষনা করে বিদ্রোহীরা কেবল নিজেদের দাবি দাওয়া পূরনের জন্য আন্দোলন করে নি। আসলে এর মধ্য দিয়ে তারা দেশীয় শাসনব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলো। বাহাদুর শাহ ছিলেন বিদ্রোহীদের কাছে ভারতের স্বাধীনতার এবং জাতীয়তার প্রতীক। ব্যক্তিস্বার্থে এই বিদ্রোহ পরিচালিত হলে কখনই বিদ্রোহীরা এমনটি করতো না। এসব থেকেই বোঝা যায়, বিদ্রোহীরা দেশপ্রেম ও স্বজাত্যবোধের দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়েই এই বিদ্রোহে সামিল হন।
(৭.) সপ্তমত - ডঃ সরকার বলেছেন, ১৮৫৭ র বিদ্রোহে সাম্প্রদায়িক বিরোধের কিছু নজির থাকলেও, হিন্দু মুসলিম ঐক্যের নিরিখে ইংরেজ শাসন উৎখাতের চিত্রটিও কম উজ্জ্বল নয়। হিন্দু মুসলিম উভয়েই মিলিত ভাবে বাহাদুর শাহকে স্বাধীন ভারতের সম্রাট হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন - এটিই এর সবথেকে বড়ো প্রমান।
তাছাড়া, সাম্প্রদায়িক সংঘাতের যুক্তিকে খন্ডন করেও বলা যায়, ১৯২০ পর জাতীয় আন্দোলন গুলিতে সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেখা দিলেও, সেগুলিকে স্বাধীনতা আন্দোলন বলতে কোন বাধা হয় নি। তাহলে কোন যুক্তিতে আমরা ১৮৫৭ র বিদ্রোহকে একটি জাতীয় সংগ্রাম বলবো না?
(৮.) অষ্টমত - ডঃ মজুমদার হিংসা, লুঠতরাজ, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট ইত্যাদি কারনে মহাবিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম বলতে ঘোর আপত্তি করেছেন। এর পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলা যায়, উল্লেখিত ঘটনা গুলির সব গুলিই তো ১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলনে দেখা গিয়েছিলো। তা সত্ত্বেও, সেটি জাতীয় সংগ্রামের স্বীকৃতি পেলে, মহাবিদ্রোহ কেন হবে না জাতীয় সংগ্রাম?
(৯.) নবমত - সবচেয়ে বড়ো কথা, ১৮৫৭ র বিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহী বিদ্রোহ হলে কখনই তা এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারতো না। তাছাড়া, ১৮৫৭ র বিদ্রোহ যদি শুধু সিপাহী বিদ্রোহ হয়, তাহলে অযোধ্যাতে সিপাহীদের বিদ্রোহ শুরু করার অনেক আগেই সেখানকার জনগন কেন বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছিলো? - এগুলির কোনটিরই সঙ্গত উত্তর যারা মহাবিদ্রোহকে জাতীয় সংগ্রাম বলার বিরোধীতা করেছেন, তারা দিতে পারেন নি।
মূল্যায়ন
সুতরাং দু পক্ষের যুক্তি গুলি ভালোভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে এবং সবদিক বিচার বিবেচনা করে, সবশেষে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, যারা ১৮৫৭ র বিদ্রোহকে একটি জাতীয় সংগ্রাম বলতে চেয়েছেন, তাদের বক্তব্য ও যুক্তিগুলি বিরুদ্ধ মতের চেয়েও অনেকবেশি জোরালো ও গ্রহনযোগ্য।
এই যুক্তিগুলি মেনে নিলে নিঃসন্দেহে ১৮৫৭ র বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা একটি জাতীয় সংগ্রাম আমরা বলতে পারি। যদিও আধুনিক জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা ও ছাঁচে মহাবিদ্রোহকে ফেলে এর মূল্যায়ন করলে, আধুনিক অর্থে মহাবিদ্রোহকে পুরোপুরি "জাতীয় সংগ্রাম" বলা যায় না। কোন কোন জায়গায় এটি "বিদ্রোহ" হিসাবেই থেকে গিয়েছিলো। কোথাও আবার এটি বিদ্রোহের উর্ধ্বে উঠে প্রকৃত অর্থে "জাতীয় সংগ্রাম" হয়ে উঠেছিলো। অযোধ্যার ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা গিয়েছিলো।
তবে এসবের মধ্যেও বলতে হয়, ইতিহাসের ঘটনাকে তার নিজস্ব সময়কালের গোন্ডির চিন্তা ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়েই আমাদের বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। আজকের চিন্তা ভাবনা দিয়ে কালকের দিনকে কখনই সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। এটি উচিৎও নয়। তাই আজকের স্বাধীনতার সংজ্ঞা বা জাতীয়তাবাদের ধারনার ছাঁচে মহাবিদ্রোহকে ফেলে তাকে মিলিয়ে দেখবার প্রচেষ্টা কখনই যথার্থ ইতিহাসবোধের পরিচায়ক বা যথার্থ ঐতিহাসিক মূল্যায়ন হতে পারে না।
১৮৫৭ র বিদ্রোহকে তাই তার নিজস্ব সমকালে দাড়িয়ে দেখলে অবশ্যই একে আমরা একটি জাতীয় সংগ্রাম বলবো। বিদ্রোহীরা বিদেশী শাসনের উচ্ছেদ চেয়েছিলো। দেশীয় ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলো। এই বিদ্রোহে সবাই যোগ দেয় নি ঠিকই। বিদ্রোহ সারা ভারতে বিস্তৃত হয় নি সত্য। কিন্তু এসবের সাথে এটাও সত্য, এই বিদ্রোহের মধ্যেই মধ্য ও উত্তর ভারতের এক বিরাট অংশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম আরম্ভ করেছিলো। এই সংগ্রামে সমগ্র ভারতবর্ষ যোগ না দিলেও, এই সংগ্রাম ছিলো উত্তর ও মধ্য ভারতের জনগনের দ্বারা পরিচালিত "সারা ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ"।
পরবর্তীকালের তথাকথিত কংগ্রেস পরিচালিত গন আন্দোলন গুলির যে গন চরিত্র, ব্যপকতা ও গভীরতা লক্ষ্য করা যায়, ১৮৫৭ র যুদ্ধ তার থেকে কোন অংশে কম ছিলো না। সবচেয়ে বড়ো কথা, কংগ্রেসের আন্দোলন গুলি ব্রিটিশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো।
কিন্তু ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহের সৈনিকরা আত্মসমর্পণের বদলে আত্মবলিদানকেই শ্রেয় বলে মনে করেছিলো। বিদেশী শক্তির বিরোধীতা করে ভারতের আর কোন যুদ্ধে একসঙ্গে এত মানুষ আত্মবলিদানও দেন নি। নিজেদের প্রানকে তুচ্ছজ্ঞানও করেন নি। আত্মবিসর্জনও দেন নি।
এর পরেও ১৮৫৭ র যুদ্ধকে যদি আমরা ভারতের "জাতীয় সংগ্রাম" বলতে কুন্ঠাবোধ করি, তাহলে সেটা শুধু অনুতাপের বিষয় হবে না - হয়ে উঠবে ইতিহাসের এক বড়ো অবমূল্যায়ন এবং প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করার এক বিরাট ঐতিহাসিক ভুল।