১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের মধ্য দিয়েই ভারতের এক বিরাট অংশের মানুষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ হয়।
- এই বিদ্রোহের জন্য সবথেকে বেশি দায়ি ছিলেন লর্ড ডালহৌসি এবং
- এই বিদ্রোহ সংগঠিত হয় তার পরবর্তী গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং এর আমলে।
সংক্ষিপ্ত তথ্যের আলোকে মহাবিদ্রোহ |
(ক.) মহাবিদ্রোহের কারন
পরোক্ষ কারন
ভারতে কোম্পানির প্রায় ১০০ বছরের শাসন (১৭৫৭ খ্রিঃ - ১৮৫৭ খ্রিঃ) (১.) সামাজিক, (২.) রাজনৈতিক,(৩.) অর্থনৈতিক, (৪.) ধর্মীয় ও (৫.) সামরিক ক্ষেত্রে ভারতীয়দের মধ্যে যে একাধিক ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দেয়, তাই মহাবিদ্রোহের প্রেক্ষাপট রচনা করে। যেমন -
- লর্ড ডালহৌসির নগ্ন সাম্রাজ্যবাদ নীতি বিশেষত, স্বত্ত্ববিলোপ নীতি ও কুশাসনের অজুহাতে একের পর এক দেশীয় রাজ্য গ্রাস দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সঞ্চার করে।
- ইংরেজ অধিকৃত দেশীয় রাজ্যের রাজপরিবারের - আশ্রিত ব্যক্তিগত, জমিদার, তালুকদার ও সেনাদলের কর্মচ্যুতি, হতাশা ও ক্ষোভ,
- কোম্পানির একচেটিয়া বানিজ্যে - দেশীয় কুটির শিল্প ধ্বংস ও বেকারত্ব বৃদ্ধি,
- উচ্চহারে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা - প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাজনা মুকুব না হওয়া, কৃষকদের ওপর মধ্যসত্ত্বভোগীদের অত্যাচার এবং কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ,
- ভারতীয়দের ওপর ব্রিটিশ সরকারের নানা ধরনের অবৈধ কর আরোপ - যেমন - পথকর, যানবাহন কর, সেতুর, গোচারন কর, গৃহকর, খাদ্যকর ইত্যাদি,
- সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতীয়দের ওপর নানা বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ - ইংরেজদের বিজেতা সুলভ আচরন, ভারতীয়দের হীন, বর্বর ও কুকুর বলে সম্বোধন করা,
- বলপূর্বক ভাবে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচার - ভারতীয় ধর্মের কটু সমালোচনা এবং মন্দির, মসজিদ ও নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর কর আরোপ করা,
- সামরিক ক্ষেত্রে নানা বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ - একই পদে কর্মরত থাকা সত্ত্বেও একজন ইওরোপীয় ও একজন ভারতীয় সিপাহীর পদমর্যাদা, বেতন ও ভাতাতে বৈষম্য, নিন্মমানের খাবার প্রদান, ভারতীয় সিপাহীদের তিলক, পাগড়ি ও দাড়ি রাখায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ইত্যাদি।
প্রত্যক্ষ কারন
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন ছিলো মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারন।
(খ.) এনফিল্ড রাইফেলের পরিচয়
- ১৮৩৯ খ্রিঃ আফগান যুদ্ধে এবং ১৮৫৬ খ্রিঃ ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর সামরিক দূর্বলতা প্রকাশ পায়। এর ফলে ব্রাউন ব্রেস রাইফেলের জায়গায় সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেল নামক নতুন বন্দুকের প্রচলন হয়।
- এনফিল্ড রাইফেলের গুলি অনেক দূর পর্যন্ত নিক্ষেপ করা যেতো। এর টোটার খোলসটি চর্বি দিয়ে তৈরি করা হতো এবং টোটাটি দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে ভরতে হতো।
- মহাবিদ্রোহের সময় গুজব ছড়িয়ে যায়, এনফিল্ড রাইফেলের টোটাটি গরু ও শূকরের চর্বি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, এবং এই টোটা সেনাবাহিনীতে প্রচলন করে ইংরেজরা সিপাহীদের ধর্মনাশ করে তাদের খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করবার পরিকল্পনা করেছে।
(গ.) মহাবিদ্রোহের প্রথম সূচনা
১৮৫৭ খ্রিঃ ২৯ মার্চ বাংলার ব্যারাকপুর সৈন্য শিবিরে মঙ্গলপান্ডে এনফিল্ড রাইফেল ব্যবহার করতে অসম্মত হন এবং প্রথম বিদ্রোহ ঘোষনা করেন।
(ঘ.) মহাবিদ্রোহের প্রকৃত সূচনা
আধুনিক ঐতিহাসিকরা ব্যারাকপুরের সেনা অভ্যুত্থানকে মহাবিদ্রোহের প্রকৃত সূচনা বলে মনে করেন না। তাদের মতে, মহাবিদ্রোহের প্রথম সূচনা হয় ১৮৫৭ খ্রিঃ ১০ মে মিরাট সেনানিবাসে।
(ঙ.) মিরাটের সেনা অভ্যুত্থানকে কেন ঐতিহাসিকরা মহাবিদ্রোহের প্রকৃত সূচনা বলে মনে করে থাকেন?
- ব্যারাকপুরের সেনা বিদ্রোহ শুরু হবার অল্পকালের মধ্যে সেখানেই শেষ হয়ে যায়।
- এই বিদ্রোহ কোনও গোপন পরিকল্পনার ফল ছিলো বলেও মনে হয় না।
- মিরাটে সেনা বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পরেই মিরাট কেন্দ্র থেকে পরিকল্পিত ভাবে বিদ্রোহ দিল্লি সহ অন্যান্য সেনা নিবাস গুলিতে পর পর ছড়িয়ে পড়েছিলো। তাই মিরাটের অভ্যুত্থানকেই সিপাহী বিদ্রোহের প্রকৃত সূচনা বলে আধুনিক ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকেন।
(চ.) মহাবিদ্রোহের প্রথম শহিদ
সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম শহীদ ছিলেন মঙ্গল পান্ডে।
(ছ.) মঙ্গলপান্ডের পরিচয়
মঙ্গলপান্ডে ছিলেন ব্যারাকপুর সেনা নিবাসের ৩৪ নং নেটিভ ইনফেন্টির একজন সিপাহী। সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেলের প্রবর্তন করা হলে মঙ্গলপান্ডে প্রথম তা ব্যবহার করতে অসম্মত হন এবং এর বিরুদ্ধে ১৮৫৭ খ্রিঃ ২৯ মার্চ বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। তিনিই ছিলেন মহাবিদ্রোহের প্রথম শহিদ।
(জ.) মহাবিদ্রোহের প্রধান নেতৃত্ব ও কে কোথায় নেতৃত্ব দেন?
- ঝাঁসি - লক্ষীবাঈ,
- কানপুর - নানা সাহেব ( প্রকৃত নাম - নানা ধুন্ধুপন্থ, তিনি পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের দত্তক পুত্র ছিলেন),
- তাঁতিয়া তোপি - নানা সাহেবের অনুচর ছিলেন। (প্রকৃত নাম - রামচন্দ্র পান্ডুরঙ্গ তোপি),
- লখনৌ - অযোধ্যার নবাব বেগম হজরৎ মহল,
- বিহার - কুনওয়ার সিং,
- আসাম - মনিরাম দেওয়ান,
(ঝ.) বিদ্রোহীরা ভারত সম্রাট হিসাবে কাকে ঘোষনা করে?
- মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদূর শাহকে বিদ্রোহীরা ভারত সম্রাট ও বিদ্রোহীদের প্রধান নেতা হিসাবে ঘোষনা করে।
- সিপাহী বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার অপরাধে ইংরেজরা বাহাদূর শাহকে বার্মার মান্দালয়ে নির্বাসনে পাঠায়। ১৮৬২ খ্রিঃ প্রচন্ড দারিদ্রতা ও কষ্টের মধ্যে থেকে তার মৃত্যু হয়।
(ঞ.) মহাবিদ্রোহের প্রধান কেন্দ্র
- দিল্লি,
- কানপুর,
- লখনৌ
- রায়বেরিলি,
- ঝাঁসি,
- বিহার,
- আসাম।
(ট.) বিদ্রোহের কোন প্রভাব পড়ে নি
- নর্মদা নদীর দক্ষিনাঞ্চল,
- রাজপুতানা,
- পাঞ্জাব,
- কাশ্মীর,
- বাংলা।
(ঠ.) মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
- ইন্ডিয়ান ওয়ার অব ইন্ডিপেনডেন্স - ভি ডি সাভারকর,
- এইট্রিন ফিফটি সেভেন - ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন,
- সিপাহী মিউটিনি অ্যান্ড রিভোল্ট অব 1857 - রমেশচন্দ্র মজুমদার,
- 1857 ইন আওয়ার হিস্ট্রি - পি সি যোশী,
- সিভিল রেবেলিয়ন ইন ইন্ডিয়ান মিউটিনি - ডঃ শশিভূষন চৌধুরী,
- সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস - রজনীকান্ত গুপ্ত,
- 1857 ও বাংলাদেশ - সুকুমার মিত্র।
(ড.) মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে প্রধান মত
সিপাহী বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ৩ টি প্রধান মত লক্ষ্য করা যায় । যথা -
(১.) সিপাহী বিদ্রোহ বা একটি সামরিক বিদ্রোহের তত্ত্ব।
- এই মতের প্রবক্তা - ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার।
- এই মতের বিরোধিতা করেছেন - সুরেন্দ্রনাথ সেন ও শশিভূষন চৌধুরী।
(২.) জাতীয় বিদ্রোহের তত্ত্ব
- এই মতের প্রবক্তা ছিলেন - ঐতিহাসিক অশোক মেহতা, রনজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র, সুপ্রকাশ রায়।
- এই মতের বিরোধিতা করেছেন - রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ
- ভি ডি সাভারকর প্রথম মহাবিদ্রোহকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার আওতার মধ্যে নিয়ে আসেন।
- তিনি ১৯০৯ খ্রিঃ এক প্রবন্ধে এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন।
(৪.) সামন্ত বিদ্রোহের তত্ত্ব
- এই মতের প্রবক্তা ছিলেন - ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, রজনীপাম দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ সেন, জুডিথ ব্রাউন।
- এই মতের বিরোধিতা করেছেন - ডঃ সুশোভন সরকার।
(ঢ.) মহাবিদ্রোহকে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেনী কেন সমর্থন করেনি?
- শ্রেনী স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে। (নিজেদের চাকুরি ও জমিদারি বাঁচানোর জন্য)
- বেঙ্গল রেজিমেন্টে কোন বাঙালি সৈন্য ছিলো না। তাই সিপাহীদের বিদ্রোহের সঙ্গে বাঙালিরা একাত্মতা অনুভব করে নি।
- মধ্যযুগ বা মুসলিম রাজত্ব শুরু হওয়ার আতঙ্কে।
- ঔপনিবেশিক শাসনের সহায়তায় যে প্রগতিশীল সংস্কার আন্দোলন চলেছিলো, তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আশঙ্কায়।
(ণ.) মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সাল ও তারিখ
- ১৮৫৭, ২৯ মার্চ - মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহ ঘোষনা।
- ১৮৫৭, ১০ মে - মিরাটে সেনা অভ্যুত্থান ও সিপাহী বিদ্রোহের প্রকৃত সূচনা।
- ১৮৫৮ - ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ভারতে কোম্পানির শাসনের অবসান ও ব্রিটিশ শাসনের সূচনা।
- ১৮৫৮, ১ নভেম্বর - মহারানীর ঘোষনাপত্র প্রচার। এটি প্রচার করেন ভারতের প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং ।
- ১৮৭৭ - মহারানী ভিক্টোরিয়াকে ভারত সম্রাজ্ঞি হিসাবে ঘোষনা করা হয়।
(ত.) গুরুত্বপূর্ণ উক্তি
- মহাবিদ্রোহ ছিলো ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ - ভি ডি সাভারকরই।
- মহাবিদ্রোহ ছিলো সামন্ততন্ত্রের মৃত্যুকালীন আর্তনাদ - ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার।
- ১৮৫৭ খ্রিঃ প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ না ছিলো প্রথম না ছিলো জাতীয়, না ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধ - রমেশচন্দ্র মজুমদার।
- মহারানীর ঘোষনাপত্র ছিলো একটি রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি - ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র।