প্রাক্ আধুনিক চিন ও নজরানা ব্যবস্থা

 প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের মতো চিনও ছিলো একটি রাজতান্ত্রিক দেশ। সেখানে পর পর সিয়া, সান, চৌ এবং চিন বংশ রাজত্ব করেছিলো। চিন বংশ থেকেই দেশের নাম হয়েছিলো চিন। চিন বংশের পরে হ্যান, তাং, সুং, মিং বংশ চিন শাসন করেছিলো। শেষপর্যন্ত মিং বংশকে উচ্ছেদ করে চিনে ক্ষমতায় আসে মাঞ্চু রাজবংশ (১৬৪৪ - ১৯১১)

মাঞ্চু রাজবংশের সময়ে চিনে ভয়ঙ্কর রকম দুর্নীতি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ঠিক এই সময়েই একের পর এক বিদেশী শক্তিগুলি চিনে প্রবেশ করতে শুরু করেছিলো।

প্রাক্ আধুনিক চিন ও নজরানা ব্যবস্থা
প্রাক্ আধুনিক চিন ও নজরানা ব্যবস্থা 


প্রাক্ আধুনিক চিনের শাসন ব্যবস্থা

প্রাক্ আধুনিক চিনে ক্ষমতা এবং শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরে ছিলেন চিনা সম্রাট। ভারতের মতোই চিনে সম্রাটকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে মনে করা হতো। সম্রাটকে চিনের লোকজন "স্বর্গের সন্তান" বলে ডাকতেন।

চিনা শাসন ব্যবস্থায় সব সরকারি কাজকর্ম সরকারি কর্মচারীরাই করতেন। এদের বলা হতো "ম্যান্ডারিন"। মিং রাজবংশের আমলে চিনা সম্রাট প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর তুলে দিয়ে একটি সচিবালয় বা "নেই - কো" প্রতিষ্ঠা করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিলো এই সচিবালয়। যাবতীয় রাজকীয় আদেশ বা ঘোষনা এই সচিবালয় থেকেই জনসাধারণের কাছে পাঠানো হতো।

চিং শাসনকালে সমগ্র চিন ১৮ টি প্রদেশে বিভক্ত ছিলো। প্রদেশ শাসনের মূল দায়িত্বে ছিলেন গর্ভনর জেনারেলরা। এদেরকে সাহায্য করতেন গর্ভনর নামের আমলারা।

আমাদের এখানে প্রদেশ গুলোকে যেমন মহকুমা, জেলা, ব্লক, গ্রাম, ইত্যাদি নানা প্রশাসনিক ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। চিনে প্রদেশ গুলোর ক্ষেত্রে তেমনটাই করা হয়েছিলো।

প্রাক্ আধুনিক চিনের সমাজ ব্যবস্থা

পেশাগত বিভাজনের ভিত্তিতে চিনা সমাজে চারটি শ্রেনী ছিলো। যথা -

  • পন্ডিত রাজকর্মচারীরা বা জেন্ট্রি শ্রেনী। এদের চিনা ভাষায় বলা হতো "শি"। ক্ষমতা, জ্ঞান এবং জমি এই তিনটি জিনিসের এরা অধিকারী ছিলেন। চিনের সবথেকে প্রভাবশালী, সুবিধাবাদী এবং গুরুত্বপূর্ণ শ্রেনীতে ছিলেন এই "শি" রা।
  • দ্বিতীয় শ্রেনীতে ছিলেন কৃষকরা। যাদেরকে চিনা ভাষায় "নং" বলে ডাকা হতো। পৃথিবীর সব দেশের সব কালের কৃষকদের অবস্থা যেমন হয়, চিনের কৃষকদের অবস্থা তেমনই ছিলো। সংখ্যার দিক থেকে অনেক বেশি হলেও, এদের অবস্থা মোটেই ভালো ছিলো না।
  • তৃতীয় শ্রেণীতে ছিলেন কারিগররা। এদেরকে বলা হতো "গং"। এদের বেশিরভাগই মূলত শহরে থাকতেন। তাঁত বোনা, সোনার গহনা তৈরি, জুতো তৈরি, এসব কাজকর্মই মূলত এরা করতেন।
  • চতুর্থ স্থানে ছিলেন বনিকরা। এদের চিনা ভাষায় "শ্যাং" বলে ডাকা হতো।
এই মূল চারটি শ্রেনী ছাড়াও চিনে অভিনেতা, গনিকা, ভৃত্য, সৈন্য, ভবঘুরে শ্রেনী গুলিও ছিলো। ভারতের মতোই চিনারা যৌথ পরিবারের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন।

কনফুসীয়পন্থা

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত চিনের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, চিন্তা ভাবনা সব কিছুকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো কনফুসিয়াসের মতাদর্শ

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের কিছুদিন আগে ৫৫১ খ্রিঃ পূর্বাব্দে চিনে কনফুসিয়াসের জন্ম হয়েছিলো। তিনি ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সময়কালের লোক। কনফুসিয়াস ছিলেন চিনের একজন পেশাদার শিক্ষক এবং দার্শনিক। তার মতাদর্শ এবং বলে যাওয়া কথা গুলোকেই এককথায় কনফুসীয়পন্থা বলা হয়ে থাকে। চিনের রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে সমাজ ব্যবস্থা সব কিছুই কনফুসীয়পন্থা মেনে পরিচালিত হতো।

কনফুসিয়াসের মূল কথা ছিলো, সমাজে প্রত্যেকটি মানুষের জন্য একটি করে ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। তাকে সেই ভূমিকা পালন করে যেতে হবে। রাজা হবেন রাজার মতো, পিতা হবেন পিতার মতো, পুত্র হবেন পুত্রের মতো, বন্ধু হবেন বন্ধুর মতো। এই ছিলো তার মূল কথা। বুদ্ধদেবের মতোই কনফুসিয়াস স্বর্গ, নরক, দেবতা এসবের বদলে একজন ভালো মানুষ, শ্রেষ্ঠ মানুষ এবং সুনাগরিক হওয়ারই শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন।

তাওবাদ

কনফুসীয়পন্থার পরেই চৈনিক চিন্তাধারায় ছিলো তাওবাদের স্থান। "তাও" শব্দের অর্থ হল পথ। তাওবাদী দর্শনের মূল কথা ছিলো প্রকৃতির মধ্যেই পথকে অনুসন্ধান করে নিতে হবে। সবাইকে প্রকৃতি সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান আহরন করতে হবে এবং প্রকৃতিকে বিশ্লেষন করতে হবে। 

 চিনের শ্রেষ্ঠত্বের ধারনা ও বিদেশনীতি

প্রাচীনকাল থেকেই চিনের লোকেরা বিশ্বাস করতো পৃথিবীটা হলো চৌকো আর স্বর্গ হলো গোল। পৃথিবীর ঠিক মাঝখানটায় স্বর্গের গোল ছায়া পড়ে। আর যে জায়গায় স্বর্গের গোল ছায়া পড়ে ওটাই হলো তাদের প্রিয় দেশ চিন। 

স্বর্গ অতি পবিত্র। তাই তাদের দেশ চিনও অতি পবিত্র। স্বর্গের মতোই তাদের দেশ স্বয়ং সম্পূর্ন। চিনের কোন অভাব নেই। কারন চিন ভগবানের দেশ। চিনা সম্রাটকে এইজন্য "স্বর্গের সন্তান" বলে চিনারা ডাকতেন।

চিনাদের এই ঐতিহ্যগত ধারনা থেকে তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতো। চিনের বাইরের লোকজনদের চিনারা বর্বর বা সামুদ্রিক দৈত্য বলেই মনে করতো। চিনের এই প্রথাগত ধারনা থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চিন" নজরানা পদ্ধতি" চালু করেছিলো। 

নজরানা ব্যবস্থা ও তার বৈশিষ্ট্য 


চিন তার দুর্বল প্রতিবেশীদের নিয়ে একটি "জাতি সমূহের পরিবার" গড়ে তুলেছিলো। এই পরিবারের সদস্য দেশ ছিলো - কোরিয়া, লিউচিউ, লাউস, মায়ানমার, শ্যামদেশ, আন্নাম। জাতিসমূহের পরিবারের প্রধান নেতা ছিলো চিন। 

 জাতিসমূহের পরিবারের দেশগুলো কে প্রত্যেক বছর একটা নির্দিষ্ট সময় মেনে চিনা সম্রাটকে নজরানা বা উপঢৌকন পাঠাতে হতো। কোন দেশ কত সময়ের ব্যবধানে নজরানা পাঠাবেন, তা চিনা সম্রাটই ঠিক করে দিতেন। 

সাধারনত যে দেশের ভৌগলিক দূরত্ব যত কাছে ছিলো, তাকে তত বেশি বার নজরানা পাঠাতে হতো। নজরানা পাঠাবার বদলে অবশ্য চিন ঐ সমস্ত দেশ গুলোতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতো। তবে ঐসব দেশে যখনই কোন নতুন রাজা সিংহাসনে বসতো, সেই খবর আগেভাগেই চিনা সম্রাটকে জানিয়ে দিতে হতো। চিনা সম্রাটের প্রতিনিধির উপস্থিতিতেই হতো নতুন রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান। 

প্রতিবেশী দেশগুলো যখন চিনা সম্রাটকে নজরানা দিতে আসতেন, তখন সঙ্গে করে দেশের বনিকদেরও নিয়ে আসতেন। প্রতিবেশী রাজা চিনা সম্রাটকে নজরানা দিয়ে দু তিন দিন রাজার অতিথি হয়ে থেকে যেতেন। ঐ সুযোগে বনিকরা বিনা শুল্কে কিছুদিন জমিয়ে বানিজ্য করে নিতো। এই বানিজ্যটি অবশ্য চিনা সম্রাটের অনুমতি নিয়েই হতো।

কাউটাউ প্রথা 

চিনের প্রতিবেশী দেশগুলো যখন চিন সম্রাটের দরবারে নজরানা নিয়ে হাজির হতেন, তখন তাদের "কাউটাউ প্রথা" তে চিনা সম্রাটকে অভিবাদন জানাতে হতো। 

কাউটাউ ছিলো অভিবাদন জানানোর একটি চৈনিক প্রথা। এই প্রথাটিতে রাজার সামনে মোট  ৯ বার নতজানু হতে হতো এবং প্রত্যেকবার নতজানু অবস্থায় নিজের মাথা মাটিতে স্পর্শ করতে হতো। 

 চিনের "রুদ্ধদ্বার" নীতি

চিনের প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো, পাশ্চাত্য দেশগুলি যখন চিনে বানিজ্য করতে এসেছিলো, তাদেরকেও চিনা সম্রাটকে নজরানা দিতে হয়েছিলো এবং কাউটাউ প্রথাতে অভিবাদন জানাতে হয়েছিলো। 

১৬৫৫ - ১৭৯৫ খ্রিঃ মধ্যে পাশ্চাত্য দেশ গুলির রাষ্ট্রদূতরা চিনে মোট ১৭ টি মিশন পাঠিয়েছিলো।এর মধ্য শুধু একবার বাদ দিয়ে, প্রতিবারই নজরানা পদ্ধতি ও কাউটাউ প্রথা অনুসৃত হয়। 

পাশ্চাত্য দেশ গুলির কাছে অবশ্য কাউটাউ প্রথাটি বড়োই বিদঘুটে এবং অপমানজনক বলে মনে হয়েছিলো। চিনা সম্রাটকে ভগবান মনে করে একটা দীর্ঘ সময় ধরে প্রনামপর্ব চালানোটা তাদের কাছে আদর্শ বিদেশনীতির পরিপন্থী বলে মনে হয়েছিলো। 

চিনা সম্রাটের অবশ্য এক্ষেত্রে অভিমত ছিলো অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বিদেশী বনিকদের পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, তোমরা তোমাদের অভাবের প্রয়োজনেই এখানে কেনাকাটা করতে এসেছো। তোমাদের সাথে ব্যবসা করবার কোন ইচ্ছে আমাদের নেই। আমরা স্বয়ং সম্পূর্ন দেশ। আমাদের কোন অভাব নেই। ব্যবসা করারও দরকার নেই। 

বিদেশীদের প্রতি চিনের এই কঠোর নীতিটাকে বিদেশীরা "চিনের রুদ্ধদ্বারা" নীতি হিসাবেই ঘোষনা করেছিলো। শুরুর দিকে কোন বিদেশী বনিকদের চিনে ঢুকতে দেওয়া হতো না। বন্দরে জাহাজ থেকেই মালপত্র কেনাবেচা করে তাদের ফিরে যেতে হতো। 

চিনে বিদেশী বনিকদের প্রবেশ

১৪৯৮ খ্রিঃ ভাস্কো দা গামা ভারতে আসবার নতুন জলপথের আবিষ্কার করলে পাশ্চাত্যের দেশ গুলির কাছে প্রাচ্যের রাস্তা উন্মুক্ত হয়ে যায়। এই অবস্থায় একের পর এক ইওরোপীয় শক্তি যেমন ভারতে প্রবেশ করেছিলো, ঠিক একই ভাবে তারা চিনেও প্রবেশ করেছিলো। 

চিনে প্রথমে এসেছিলো পোর্তুগিজরা। শুরুর দিকে চিন সরকার ওদের জাহাজকে চিনে ঢুকতেই দেয় নি। বারকতক এমন হবার পর শেষপর্যন্ত অনুনয় বিনয়ের বদলে তারা ম্যাকাও বন্দরে একগুচ্ছ কঠোর শর্তের বিনিময়ে ব্যবসা করবার সুযোগ লাভ করে। 

পর্তুগালের পর ওলন্দাজরা চিনে এসেছিলো। তারাও বেশ কয়েকবার দূত পাঠাবার পর অবশেষে চিন সম্রাটের দয়ায় ক্যান্টন বন্দরে শর্তাধীনে ব্যবসা করবার অনুমতি লাভ করেছিলো। হল্যান্ডের পর ইংরেজ বনিকরা চিনে প্রবেশ করে। তাদের ক্ষেত্রেও চিন সরকার শর্তাধীনে ক্যান্টন বন্দরে বানিজ্যের অনুমতি দেয়। তবে কোন ক্ষেত্রেই সরাসরি বানিজ্য করবার কোন অধিকার ইওরোপীয়দের দেওয়া হয় নি। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post