কেন সূর্যসেনের মৃতদেহ গভীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়?

 ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বহু বিপ্লবী তাদের প্রান বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের গল্পটি আমরা কম বেশি সবাই জানি। সেই গল্পটা এখানে আমরা বলবো না। আমরা বলবো, অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পরে যখন গৈরালা গ্রামের একটি বাড়ি থেকে ১৯৩৩ খ্রিঃ ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশ সূর্য সেনকে গ্রেপ্তার করলো, তার পর সূর্য সেনের পরিনতি কি হলো সেই গল্প।

কেন সূর্যসেনের মৃতদেহ গভীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়?
কেন সূর্যসেনের মৃতদেহ গভীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়? 


ভারতে ব্রিটিশ সরকার যে ৩টি বিষয়কে ব্যবহার করে ত্রাসের সৃষ্টি করতো,তার মধ্যে একটি ছিলো "দমনমূলক আইন" অপর দুটি ছিলো - "অত্যাচারী পুলিশ" আর "জেল"। পুলিশ আর জেল কতটা যে ভয়াবহ ছিলো, তা বোঝানোর জন্য একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। 

আমরা সবাই জানি, পরাধীন ভারতে প্রতিটি বিপ্লবীদের কাছেই থাকতো পটাসিয়াম সায়ানায়েড। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার প্রাক্ মুহুর্তে অনেকেই এটা খেয়ে আত্মহত্যা করতেন। কারন তারা জানতেন, পুলিশের বর্বর নারকীয় অত্যাচার থেকে মৃত্যু অনেক সহজ এবং শ্রেয়। কি বলছেন? কিরকম অত্যাচার করা হতো জেলের ভিতর? আরে মশাই সব বলবো, একটু ধৈর্য্য ধরে শুনুন না।

আচ্ছা, কংগ্রেসের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। এটাও নিশ্চয়ই ইতিহাস বইয়ে পড়েছেন, কংগ্রেস মাঝে মধ্যেই একটা দুটো আন্দোলন করতো আর শয়ে শয়ে কংগ্রেস কর্মী, নেতা সবাই জেলে যেতেন। জেল যাওয়াটাকে তারা এক্কেবারে দেশপ্রেমের স্ট্যাটাসে পরিনত করেছিলেন। 

এখনও সেই স্ট্যাটাস থেকে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বেরোতে পারে নি। দুর্নীতি, ঘুষখোর নেতারা জেলে যাওয়ার আগে এমন একখানা ভাব দেখান যে, তারা দেশকে স্বাধীন করার জন্য জেলে যাচ্ছেন। কেন হবে না বলুন তো! তাদের জন্য জেলটা  তো আর জেল থাকে না। জেলটা হয়ে ওঠে ছুটি কাটানোর জায়গা।

আপনাকে নিশ্চয়ই ইতিহাস বইয়ে পড়ানো হয়েছে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটো ধারা ছিলো। একটা নরমপন্থী বা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা। যেটা চালাতো গান্ধী আর কংগ্রেস। সাত, পাঁচ ভেবে, সমঝোতা করে, নিয়মের ঘেরাটোপে তারা আন্দোলন করতেন। সেই আন্দোলনে যেই না পাবলিক লক্ষনরেখা ক্রশ করতো, তখনই তারা বলে উঠতেন - এই স্টপ! স্টপ! চৌরিচৌরাতে যেমনটা হয়েছিলো আরকি!

এর বাইরেও ছিলো আরেকটা ধারা। যেটাকে অনেকেই. বলেন বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা। এটাকে কংগ্রেস ঘরানা আর সাম্রাজ্যবাদের দালাল ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ধারা। এই ধারার সংগ্রামী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন - ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, বিনয় - বাদল-দীনেশ, ভগৎ সিং, রাজগুরু, শুকদেব, সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার, সর্বোপরি আমাদের প্রিয় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।

তো যেকথা বলছিলাম, স্বাধীনতা আন্দোলনের এই দুই ঘরানার ব্যক্তিদেরই জেলে যেতে হতো। তবে কংগ্রেসের অনেক নেতাদের কাছে জেল যাওয়াটা বেশ গর্বের ই ছিলো। সেখানে তাদের রাজবন্দীর মর্যাদা দেওয়া হতো। জেলে হরেক রকমের সুযোগ সুবিধা তারা পেতেন। জওহরলাল তো জেলে বসেই দুটো বই লিখে আজও আমাদের কাছে ফেমাস হয়ে আছেন। এছাড়া, জেলে ভালো খাবার, বই, সংবাদপত্র, সবই তাদের জন্য থাকতো।

আর অন্যদিকে যারা দেশকে ভালোবেসে, নিজের জীবন বাজি রেখে সশস্ত্র সংগ্রাম করতেন, সেই বিপ্লবীদের জেল কেমন ছিলো আপনি জানেন? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। আপনি যা ভাবছেন একদম ঠিক তাই।

তাদের রাখা হতো একজন সন্ত্রাসবাদী কয়েদিদের মতো। আসলে তাদের কাজটাই তো ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভয় দেখানো, ত্রাস দেখানো। সুতরাং ধরা পড়ার পর ব্রিটিশ সরকার ছাড়বে কেন! বিপ্লবীদের পাল্টা জেলের ভিতর ভরে তারা ত্রাস দেখাতো। ব্রিটিশ সরকারের জেল যে কি জিনিস, তা একমাত্র বিপ্লবীরাই জানতেন।

অনেক বিপ্লবী তাই জেলে যাওয়ার আগে আত্মহত্যা করতেন। এমন অনেক বিপ্লবী ছিলেন, যারা জেলে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে গলায় কাপড়ের ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

প্রচন্ড গরমে জলের জন্য যখন তারা চিৎকার করে উঠতেন, তখন তাদের জলের বদলে দেওয়া হতো বুটের প্রহার। প্রচন্ড ঠান্ডায় বরফের চাঁইয়ের মধ্যে তাদের নগ্ন করে শুইয়ে চলতো নির্মম বেত্রাঘাত।

শোনা যায়, সূর্য সেন জেলে থাকার সময় তার জীবন্ত শরীর থেকে হাত এবং পায়ের সমস্ত নখগুলো তুলে নেওয়া হয়েছিলো। শরীরের সমস্ত হাড় গুলো হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে গুড়ো করে দেওয়া হয়েছিলো। আর সবশেষে ১৯৩৪ খ্রিঃ ১২ জানুয়ারি, রাত্রি প্রায় দু টোর সময় অর্ধমৃত দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। ফাঁসির পর তার মৃতদেহটা বাড়ির লোকেদের দেওয়া হয় নি। গভীর সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো। (তথ্য সূত্র : অগ্নিযুগের ফাঁসি - শুভেন্দু মজুমদার) 

শুধু সূর্য সেন কেন, ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের কোন মৃতদেহকেই ইংরেজ পুলিশ তাদের আত্মীয় স্বজনদের হাতে তুলে দিত না। ফাঁসির পর জেল চত্বরের কোথাও হয়তো পুঁতে দিতো, অথবা গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করতো।

পরাধীন ভারতে কংগ্রেস নেতারা জেল থেকে বেরোনোর পর হাসি মুখে ফুলের মালা পরতো। অন্যদিকে তরুন বিপ্লবীদের খুব কম জনেরই সৌভাগ্য হতো জেল থেকে বেরোনোর। যারা জেল থেকে বেরোতেন তারা আর বেশি দিন বাঁচতেন না।


এবার আসি সেই গল্পটায়, যেটার জন্য আপনি এখনও ধৈর্য্য ধরে আমার বকবকানি শুনছেন। ফাঁসির পর সূর্য সেনের বডিটা কেন তার বাড়ির লোকেদের হাতে দেওয়া হয় নি? কেনই বা সেটা গভীর সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো?

এখানে একটা কথা বলে রাখি, শুধু সূর্য সেন নয়, প্রায় সব ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের ক্ষেত্রেই এমনটা করা হতো। ফাঁসির পর লাশ গুলোকে নিয়ে পুলিশ কি করতো, তা সত্যিই এক রহস্য ছিলো!

যাইহোক, এবার একটু সিরিয়াস ভাবে আসল কারনের গল্পটা বলি। ক্ষুদিরামকে নিশ্চয়ই আপনারা কেউ ভুলে যান নি। ভারতের প্রথম শহীদ ছিলেন। যুগান্তর দল তাকে এবং প্রফুল্ল চাকীকে অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার ভার দিয়েছিলো। ঘটনাচক্রে একটু ভুলের জন্য কাজটা করা যায় নি। ধরা পড়ে গেলেন ক্ষুদিরাম। প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়া অবশ্যম্ভাবী দেখে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

যাইহোক, কিংসফোর্ড হত্যার সূত্র ধরে ব্রিটিশ পুলিশ কলকাতার মুরারিপুকুর থেকে একটি বোমা তৈরির কারখানার হদিস পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় বেশ কিছু বিপ্লবীকে। এদের মধ্যে দুজন বিপ্লবীদের কথা বলবো। কারন গল্পটা তো তাদের নিয়েই।

কিংসফোর্ড হত্যার পর বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের বিপ্লবীদের নিয়ে সরকার আলিপুর বোমা মামলা দায়ের করেছিলো। এই মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছিলেন নরেন গোস্বামী। প্রান বাঁচাতে বিপ্লবীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে সব পরিকল্পনা তিনি ফাঁস করে দিয়েছিলেন।

এই সময় জেলের ভিতরে কানাইলাল দত্ত নামে এক বিপ্লবী নরেন গোস্বামীকে হত্যা করেন। বিচারে কানাইলালের ফাঁসি হয়েছিলো।

ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীর পর এই কানাইলাল ই ছিলেন ভারতের তৃতীয় শহীদ ব্যক্তি। ফাঁসির পর কানাইলালের দেহ তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিলো। আর তারপরই যা ঘটেছিলো তা ব্রিটিশ সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।


কানাইলাল দত্ত
কানাইলাল দত্ত। ছবিঋন - অগ্নিযুগের ফাঁসি, শুভেন্দু মজুমদার। 




কানাইলালের মৃত্যুর প্রায় ১৫ বছর পর তার শেষযাত্রা নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন মতিলাল রায়। বইটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছিলো। এই বই থেকে জানা যায়, জেল থেকে মৃতদেহটি যখন নিয়ে যাওয়া হয় তখন শবদেহ ঘিরে কলকাতায় এক বিরাট জনপ্লাবন দেখা গিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ শব দেহ কে দেখার জন্য রাস্তায় নেমে পড়েছিল।

ব্রিটিশ পুলিশের পদস্থ কর্মচারী এফ. সি. ভ্যালি তার রিপোর্টে এর একটি বিবরন দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন -

"এটা ছিলো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। জনতা রাস্তায় এসে ভিড় করেছিলো। লোকেরা একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে শবদেহ স্পর্শ করতে লাগলো। তাদের অনেকে ফুল দিয়ে, অনেকে তেল দিয়ে শব দেহ কে অভিষিক্ত করছিলো। সবাই চায় একবারের জন্য হলেও শববাহী খাটটিকে ছুঁতে। সর্বত্র জয় কানাই ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিলো। কেওড়াতলা শশ্মানে দাহকার্যের পর কানাইলালের চিতাভষ্ম কেনার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়। আধ ছটাক চিতাভষ্মের জন্য কোনও অত্যুতসাহী পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। কানাইলাল দত্তের চিতাভষ্ম বলে কলকাতায় যা বিক্রি হয়েছিলো, অনুমান করা হচ্ছে, তা চিতাভষ্মের প্রকৃত পরিমানের চেয়ে অন্তত ৫০ গুন বেশি।"

এই রিপোর্টের পর ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ভবিষ্যতে মৃত্যুদন্ড দন্ডিত আসামীর মরদেহ আর অন্তোষ্টির জন্য দেওয়া হবে না। এই মর্মে ১৯০৮ খ্রিঃ ১৭ নভেম্বর জেল প্রশাসনের তরফ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয় -

" মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত ব্যক্তির মৃতদেহ আর তার পরিবারের বা আত্মীয় স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হবে না।"

ব্রিটিশ সরকার তার শেষ দিন পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছিলো। এই নিষেধাজ্ঞার জন্যই কানাইলাল দত্তের পর আর কোন মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত ব্যক্তির মৃতদেহ তার বাড়ির লোকেদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয় নি।

আসলে কানাইলাল দত্তের মৃতদেহকে কেন্দ্র করে যে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী ক্ষোভের স্ফূরন ঘটেছিলো, তাতে ব্রিটিশ সরকার চরম বিপদের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিল। ভবিষ্যতে যাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই জন্য সরকার তৎপর হয়ে উঠেছিলো।


১৯০৮ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত মোট ৪১ জন বাঙালিকে বিভিন্ন জেলে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিলো। এদের সকলেরই বয়স ২৭ এর মধ্যেই ছিলো। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন। সবথেকে বেশি বয়সে তাঁর ফাঁসি হয়। যখন তার ফাঁসি হয় তখন তার বয়স ছিলো চল্লিশ বছর। ফাঁসি দিয়েছিলেন শিবু ডোম। পুরো নাম - শিবলাল

তাহলে বুঝতে পারলেন তো, কেন ফাঁসির পর ব্রিটিশ সরকার মৃতদেহ গুলো তাদের স্বজন পরিজনদের হাতে না দিয়ে রাতের অন্ধকারে গায়েব করে দিতো। মাস্টারদার ব্যাপারটাও নিশ্চয়ই বুঝেছেন, কেন তাঁর মৃতদেহটা গভীর সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো। যদি তা না করা হতো, তাহলে জেলের নগ্ন অত্যাচারের ছবিটা যে সবার সামনে চলে আসতো।

বন্ধুরা, এমনই আমাদের মহান বিপ্লবীরা ছিলেন। মরার পরও যাদের ভয়ে ব্রিটিশ সরকার তটস্থ থাকতো। আপনি কি সত্যিই এদের সমর্থন করেন? নাকি কংগ্রেসের ভয়হীন, ঝুঁকিহীন, আরামদায়ক আন্দোলনের পথটিকে সমর্থন করেন? মতামত অবশ্যই জানাবেন। 

ইতিহাসের অন্তরালে থাকা আমাদের আজকের গল্প কেমন লাগলো আপনার, জানাতে ভুলবেন না যেন। কথা হবে পরের দিন, অন্য আরেক গল্পের সাথে।




Post a Comment (0)
Previous Post Next Post