১. নতুন সামাজিক ইতিহাসের সংজ্ঞা:-
নতুন সামাজিক ইতিহাস হল আধুনিক ইতিহাস চর্চার একটি নতুন ধারা বা পদ্ধতি, যেখানে আগেকার রাজা, মহারাজা কেন্দ্রীক ইতিহাসের বদলে সাধারণ মানুষের জীবনের কাহিনীকে ইতিহাসে তুলে ধরা হয়।
খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে নতুন সামাজিক ইতিহাসের মূল দুইটি দিক রয়েছে -
(ক) এই ইতিহাস হল সাধারণ মানুষের জীবন চর্চার ইতিহাস। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে যা কিছু যুক্ত, খেলাধুলা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক পরিচ্ছদ, যানবাহন, বিনোদন, শিল্পকর্ম সবকিছুকে নিয়ে পরিপূর্ণ ভাবে অতীতকে জানার ইতিহাস ই হল নতুন সামাজিক ইতিহাস।
(খ) নতুন সামাজিক ইতিহাসের আরেকটি বিশেষ দিক হল, এটি হল এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস, যেখানে তল থেকে অর্থাৎ নীচ থেকে ইতিহাসকে দেখা হয় এবং বিশ্লেষণ করা হয়। নতুন সামাজিক ইতিহাসকে তাই ঐতিহাসিকরা সংশোধনবাদী ইতিহাসও বলে থাকেন।
নতুন সামাজিক ইতিহাস |
(২) প্রথাগত ইতিহাসের সঙ্গে নতুন সামাজিক ইতিহাসের পার্থক্য:-
প্রথাগত ইতিহাসের সঙ্গে নতুন সামাজিক ইতিহাসের বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে -
১. প্রথাগত ইতিহাসে যুগের বড়ো বড়ো এবং প্রভাবশালী ঘটনা গুলিকেই ইতিহাস বলে মনে করা হতো। কিন্তু নতুন সামাজিক ইতিহাসে ছোট ছোট ঘটনা গুলিকেই ইতিহাসের চালিকা শক্তি মনে করা হয়।
২. প্রথাগত ইতিহাসে রাজনৈতিক ঘটনাকেই ইতিহাসের কেন্দ্রীয় বিষয় বলে মনে করা হতো। কিন্তু নতুন সামাজিক ইতিহাস সাধারন মানুষের জীবনের কথা বলে। সাধারন মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে যা কিছু যুক্ত, সবকিছুই আলোচনা করে।
৩.প্রথাগত ইতিহাস জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার ওপর গুরুত্ব দেয়। সেখানে নতুন সামাজিক ইতিহাস স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় বেশি গুরুত্ব দেয়।
৪.প্রথাগত ইতিহাস চর্চায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের বাইরে সরকারি নথিপত্রকেই ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপাদান বলে মনে করা হয়। কিন্তু নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চায় উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য দেখা যায়। সাধারন মানুষের ব্যক্তিগত ডায়েরি, হিসাব লেখার খাতা, পারিবারিক এলবাম থেকে শুরু করে গান - বাজনা, কবিতা, নাটক, সাহিত্য, সবকিছুই ইতিহাস চর্চার উপাদান হয়ে উঠেছে।
এই কারনে সামাজিক ইতিহাসকে ঐতিহাসিকরা অন্য রকমের ইতিহাস বলে থাকেন।
৩. বিভিন্ন দেশে নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত:-
সময়কাল :- ১৯৬০ এর দশকে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি ও আমেরিকা প্রভৃতি দেশগুলিতে নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত ঘটে।
ফ্রান্সে সামাজিক ইতিহাস চর্চা:-
১. ফ্রান্সে অ্যানাল স্কুল মতবাদের ঐতিহাসিকরা ছিলেন এই ধারার ইতিহাস চর্চার পথিকৃৎ।
২. ১৯২৮ খ্রিঃ ফ্রান্সে মার্ক ব্লখ এবং লুসিয়েন ফ্লেবর "দ্যা অ্যানাল পত্রিকা" প্রকাশ করেন।
৩. ১৯২৯ খ্রিঃ এদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে "অ্যানাল স্কুল"। এই ঘরানার ঐতিহাসিকরাই প্রথম সামাজিক ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত করেন।
৪. অ্যানাল স্কুল পদ্ধতি :- ফ্রান্সের ঐতিহাসিকরা ইতিহাস চর্চায় নিয়ে এলেন অ্যানাল স্কুল পদ্ধতি, যেখানে তারা ইতিহাস চর্চায় দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করলেন -
(ক) Total History তে গুরুত্ব :-
অ্যানাল স্কুলের ঐতিহাসিকরা ইতিহাস চর্চায় "Total History" বা সম্পূর্ন ইতিহাসকে জানবার ওপর গুরুত্ব দিলেন।
(খ) ইতিহাসে আন্তবিভাগীয় প্রয়োগ:-
অর্থাৎ তারা বললেন, আমরা শুধু অতীতের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ঘটনাই শুধু জানবো না। অতীতের total time এর সব ঘটনা গুলিকেই জানবো। সম্পূর্ন অতীতকে জানার জন্য তারা মানুষের জীবন ধারার সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি বিষয়ের ওপর ডুব দেওয়ার কথা বললেন।
তারা ইতিহাস চর্চায় আন্তবিভাগীয় প্রয়োগের কথা বললেন। অর্থাৎ ইতিহাসের সঙ্গে মনস্তত্ত্ব, ভূগোল, বিজ্ঞান, গনিত, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, প্রযুক্তিবিদ্যা,বিনোদন, পরিবেশ সব কিছুকে যুক্ত করবার কথা বললেন।
ইংল্যান্ডে সামাজিক ইতিহাস চর্চা :-
ইংল্যান্ডে সামাজিক ইতিহাস চর্চার জনক ছিলেন জি. এম. ট্রাভেলিয়ন। তিনি "পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট" পত্রিকার মধ্য দিয়ে নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত করেন।
আমেরিকায় সামাজিক ইতিহাস চর্চা :-
আমেরিকায় সামাজিক ইতিহাস চর্চার পথিকৃৎ ছিলেন ঐতিহাসিক ইউজিন জেনভিস এবং হার্বাট গুটম্যান। তাঁরা তাদের ইতিহাস চর্চায় দাস সমাজ, ক্রীতদাস প্রথা, এবং শ্রমিক জীবনের নানা দিকগুলিকে নিয়ে আলোচনা করেন।
ভারতে সামাজিক ইতিহাস চর্চা :-
ভারতে এই ধারার ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত হয় ১৯৮০ র দশকে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রনজিৎ গুহ র হাত ধরে।
১৯৮২ খ্রিঃ তিনি প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "সাবল্টন স্টাডিজ"। এই গ্রন্থটির মধ্য দিয়েই ভারতে সামাজিক ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত ঘটে।
নিন্মবর্গের ইতিহাসচর্চা :-
ভারতে সামাজিক ইতিহাস চর্চার নতুন নাম দেওয়া হয় - "নিন্মবর্গের ইতিহাস চর্চা"।
বর্তমানে জ্ঞান পান্ডে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র প্রমুখ ঐতিহাসিকরা এই ইতিহাসচর্চা কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
(৪) সামাজিক ইতিহাস চর্চার বৈশিষ্ট্য :-
১. নতুন সামাজিক ইতিহাস বড়ো মানুষের বদলে সাধারন মানুষের কথা বলে।
২. সামাজিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে " Top Down" পদ্ধতির বদলে "Bottom up" পদ্ধতির অনুসরন করা হয়। অর্থাৎ ওপর থেকে ইতিহাসকে না দেখে ইতিহাসকে নীচ থেকে দেখা হয় এবং বিশ্লেষন করা হয়।
বিষয়টা আরও ভালোভাবে বোঝবার জন্য একটা উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনাতে প্রথাগত ইতিহাস চর্চায়, মহাত্মা গান্ধীকে খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হতো। এই ইতিহাস পড়ে মনে হতো গান্ধী পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন এবং ভারত ছাড়াও আন্দোলনের জন্যই ভারতে স্বাধীনতা এসেছে। অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীর অবিসংবাদিত ভূমিকার কথা তুলে ধরা হতো। তার বিরাট ব্যাক্তিত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হতো। বড়ো বড়ো আন্দোলনকে ধরে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের ব্যাখ্যা দেওয়া হতো। এটাই হচ্ছে Top Down পদ্ধতি, যেখানে ঝরনার ধারার মতো ওপর থেকে ইতিহাস নেমে এসেছে। প্রথাগত ইতিহাস চর্চায় এই ভাবেই ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে।
অন্যদিকে নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চায় এর ঠিক বিপরীত ঢঙে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন করা হয়। এটা হচ্ছে Bottom up পদ্ধতি, অর্থাৎ এখানে তল থেকে বা নীচ থেকে ইতিহাসকে দেখা হয় ও বিচার করা হয়।
এই ইতিহাস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধীর অবিসংবাদিত ভূমিকার বিরোধিতা করে বলে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধীর ভূমিকাকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, আদৌও তা ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চায় দেখা যায় গান্ধীর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর্বে স্থানীয় স্তরে অসংখ্য ছোট ছোট কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন চলেছিলো। এতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নাম না জানা বহু অখ্যাত নেতা। এইসব ছোট ছোট আন্দোলন এবং নেতৃত্বের গুনেই অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রবল আকার ধারন করেছিলো। অর্থাৎ বড়ো আন্দোলন গুলি ছোট ছোট আন্দোলনেরই পুঞ্জিভূত রূপ ছিলো। বড়ো নেতৃত্বের স্থায়িত্ব, সাফল্য ছোট ও মধ্যম স্তরের নেতৃত্বের ওপরেই নির্ভরশীল ছিলো।
এটাই হলো সামাজিক ইতিহাসের Bottom up পদ্ধতি। যার মূল উদ্দেশ্য হল তল থেকে ইতিহাসকে দেখা এবং প্রকৃত সত্যের অন্বেষণ করা।
নতুন সামাজিক ইতিহাসের BOTTOM UP পদ্ধতির জন্যই এখনকার স্কুলের ইতিহাস পাঠ্য বইগুলোতে গান্ধীর উপস্থিতি আর তেমন ভাবে দেখা যায় না। অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মূল ইতিহাসের বদলে এখন আলোচনা করা হচ্ছে এই আন্দোলন গুলির পর্বে ঘটে যাওয়া নামহীন, খ্যাতি হীন কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন গুলো নিয়ে। বর্তমানে মাধ্যমিকের ইতিহাস বইয়ে এর যথার্থ প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। একই ভাবে Bottom up পদ্ধতি অনুসারে সুভাষ চন্দ্র বসুর বদলে এখন ইতিহাস আলোচনায় গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠছে আজাদ হিন্দ ফৌজের অবদান পর্যালোচনা। এই মৌলিক কারনটির জন্যই দেখা যায়, আগে পরীক্ষায় যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদান কতখানি ছিলো এই ধরনের প্রশ্ন পড়তো। এখন সেখানে আসছে স্বাধীনতা সংগ্রামে আজাদ হিন্দ ফৌজের অবদান কতখানি ছিলো, এই ধরনের প্রশ্ন অথবা আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া গন অভ্যুত্থান সম্পর্কিত প্রশ্ন।
এবার সামাজিক ইতিহাসের তৃতীয় বৈশিষ্ট্যে আসা যাক।
৩. নতুন সামাজিক ইতিহাসের আলোচনার পরিসর অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। সমাজের সব কিছুই, যা মানুষের জীবনকে ও সমাজকে প্রভাবিত করে, তা এই ইতিহাস চর্চায় স্থান পেয়েছে।
৪. জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরের বড়ো বড়ো ঘটনা গুলোর বদলে স্থানীয় বা Iocal History কে এই ইতিহাস চর্চায় গুরুত্ব দেওয়া হয়।
৫. সামাজিক ইতিহাস চর্চার উপাদানের বৈচিত্র্য বহুবিধ। সাধারন মানুষের ব্যক্তিগত ডায়েরি, হিসাব লেখার খাতা, পারিবারিক এলবাম থেকে শুরু করে গান বাজনা, কবিতা, নাটক, খেলাধুলা, পোশাক পরিচ্ছেদ, চলচ্চিত্র - সবকিছুই হয়ে উঠেছে এই ইতিহাস চর্চার উপাদান।
(৫) নতুন সামাজিক ইতিহাসের গুরুত্ব :-
১. নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে সত্যের অনেকটা কাছাকাছি জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পারছি। যে কারনে বর্তমানে এই ইতিহাস চর্চা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
২. একমাত্র নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়েই আমরা Total History বা সম্পূর্ন অতীতে পৌঁছাতে পারি বা অতীতের সমগ্র দিকগুলো সম্পর্কে ধারনা করতে পারি।
৩. এছাড়া নতুন সামাজিক ইতিহাস চর্চা ই পারে সময়ের সঙ্গে সাধারন মানুষ এবং তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের বদলে যাওয়ার ইতিবৃত্তকে সঠিক ভাবে তুলে ধরতে।